মোছা. ফায়জুন্নাহার শান্তা ( আইন ও বিচার বিভাগ ১ম বর্ষ) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
গাজায় আগুন ঝরছে, শিশুরা ছিন্নভিন্ন, নারীরা শোকাহত, হাসপাতাল ভেঙে পড়ছে একে একে। আকাশজুড়ে শুধু ড্রোন, বারুদের গন্ধ আর কান্না। অথচ এই গাজার চারপাশেই তো মুসলিম রাষ্ট্র! একটির পর একটি, অনেকটা ব্যুহের মতোই ঘিরে রেখেছে এই ভূখণ্ডকে।আমরা অনেকেই হতাশ হয়ে বলি—“মুসলমানরা যদি এক হতো, ফিলিস্তিনকে বাঁচানো যেত।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন তারা এক নয়?এর উত্তর খুঁজতে গেলে ধরা পড়ে একটি নির্মম বাস্তবতা—ধর্মীয় আবেগ যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই শুরু হয় ভূরাজনীতি।আমরা অনেকেই ভাবি, ‘মুসলমানরা এক হলে তো ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া যেতো।’একটা ছোট্ট দেশ—ইসরায়েল। চারপাশে শুধু মুসলিম দেশ তবু কেউ গাজাকে বাঁচাতে পারে না। কেন? কারণ মুসলিম বিশ্ব আজ বিভক্ত। কারণ কেউ আমেরিকার ঘনিষ্ঠ, কেউ ইরানের শত্রু। কারণ কেউ ব্যবসা দেখে, কেউ ক্ষমতা। কারণ কেউ শিয়া-সুন্নি দেখে, উম্মাহ নয়। আর যারা রুখে দাঁড়ায়, তারা একা। মুসলিম বিশ্ব আজ মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে—১. সুন্নি ব্লক : এই গোষ্ঠীর দেশগুলো মূলত আমেরিকার মিত্র এবং পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যত নিরব দর্শক।এই দেশগুলোর নীতিগত অবস্থান বরাবরই ‘স্থিতিশীলতা’ ও ‘পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষা’র পক্ষে। ফিলিস্তিন নিয়ে যতই বিবৃতি আসুক না কেন, এগুলোর বাস্তব কার্যক্রম প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাদের মুখে ফিলিস্তিনের জন্য সহানুভূতি, কিন্তু হাতে ধরা চুক্তি পশ্চিমাদের সঙ্গে। তাদের প্রথম লক্ষ্য রাজত্ব টিকিয়ে রাখা, উম্মাহ নয়। এই ব্লকে আছে— • সৌদি আরব • সংযুক্ত আরব আমিরাত • ওমান • মিশর • জর্ডান • বাহরাইন এক সময় যারা ফিলিস্তিনের জন্য যুদ্ধের ডাক দিত এখন তারাই ইসরায়েলি পর্যটকদের জন্য ভিসা সহজ করে। যাদের সঙ্গী হওয়ার কথা ছিল গাজার রক্তাক্ত শিশুদের, তারা আজ লভ্যাংশে চোখ রাখে। ২. প্রতিরোধ অক্ষ : এই জোট রাশিয়া ও চিনপন্থী। যার নেতৃত্বে অনারব ইরান। হ্যাঁ, শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু অন্তত এরা জানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধু বিবৃতি নয়, রুখে দাঁড়ানোই প্রকৃত দায়িত্ব। এই অক্ষে রয়েছে— • ইরান • হিজবুল্লাহ (লেবানন) • হুতি (ইয়েমেন) • আসাদের সিরিয়া • হামাস • ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া • কিছু আফগান গোষ্ঠী তাদের রকেট হয়তো সীমিত, তাদের সৈন্য হয়তো গুটিকয়েক, কিন্তু তাদের বুকের সাহস প্রশ্নাতীত। তারপরও তারা একা। মুসলিম বিশ্বের বড় একটা অংশ চোখ বুজে থাকে। কারণ শিয়া-সুন্নির রাজনীতিতে তারা গাজার কান্না শুনতে পায় না।
তুরস্কের দ্বৈত অবস্থান : তুরস্কের কথা আলাদা করে বলতে হয়। এরদোয়ান যখন গলা তুলে বলেন ”জেরুজালেম আমাদের হৃদয়” তখন আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য, ইউরোপীয় কাউন্সিলের অংশ। তাই যত আবেগই থাকুক, তার হাত-পা বাঁধা নীতির দড়িতে।তাহলে কি ঘটছে বাস্তবে?
• আমেরিকা একে একে প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করে দিয়েছে। • সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে। • হিজবুল্লাহকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে লেবাননে। • ইয়েমেনে সৌদি আরবকে দিয়ে হুতি দমন করানো হয়েছে। • ইরাকে শিয়াদের প্রভাব কমানো হয়েছে। • ইরানকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ফাঁদে ফেলে রাখা হয়েছে। • এরপর তারা টার্গেট করলো গাজাকে।২০২৩ সালের অক্টোবরের ৭ তারিখ হামাসের ‘আল আকসা ফ্লাড অপারেশন’ ছিল প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু ইসরায়েলের সাজানো ফাঁদে পা দিয়েছিল তারা। তারপর শুরু হয় প্রতিশোধের নামে গণহত্যা। শিশুরা পুড়ে যায়, নারীরা বিদীর্ণ হয়, পুরুষেরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে।চারপাশে মুসলিম রাষ্ট্র, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না।কারণটা সহজ—তারা এক নয়। তারা বিভক্ত, দ্বিধান্বিত,তারা ভীত এবং পশ্চিমা প্রভাবাধীন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নয়। এইখানেই ধর্মীয় আবেগ থেমে যায়, শুরু হয় ভূরাজনীতি। আর যখন আপনি ভূরাজনীতি বুঝবেন, তখন উপলব্ধি করবেন ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকে আছে এই বিভাজনের কারণেই। আর যতদিন এই বিভাজন থাকবে, ততদিন গাজা, পশ্চিম তীর বা জেরুজালেম—কোথাও প্রকৃত মুক্তি আসবে না।ইসরায়েল একা কিছুই না, কিন্তু তার পেছনে আছে কূটনীতি, সামরিক জোট, অর্থনীতি আর আমাদের বিভাজন। যতদিন এই মুসলিম বিশ্ব এক হতে পারবে না, ততদিন গাজার আকাশে আগুন, আর মাটিতে রক্তই ঝরবে।ইসরায়েলের অস্তিত্ব শক্তিশালী নয় শুধু তার অস্ত্রাগারে—তা শক্তিশালী আমাদের দুর্বলতার কারণে।গাজার আকাশ থেকে যতদিন আগুন ঝরবে, গলিতে গলিতে যতদিন শিশুর রক্ত ঝরবে, ততদিন মুসলিম বিশ্বকে আত্মসমালোচনার আয়নায় তাকাতে হবে।
উত্তর স্পষ্ট—গাজার মুক্তি আসবে না কেবল মৌন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে, আসবে প্রতিবাদ, একতা, ন্যায় ও সাহসের সমন্বয়ে।

